গ্রুপ পর্বের শুরুটা দুর্দান্ত হয়েছে রাশিয়ার। একই সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনেরও। নিজের দেশের ফুটবল দলের মতোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এক অর্থে ঘোল খাইয়ে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তাঁর আক্রমণাত্মক খেলায় নাকানি-চুবানি খেয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। মাঠে রাশিয়া জিতুক বা হারুক, পুতিনের জয় কেউ ঠেকাতে পারছে না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চলমান বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট উপলক্ষে গুটিকয়েক দেশ বাদে বেশির ভাগ বিশ্বনেতা রাশিয়ায় জড়ো হচ্ছেন। এতে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া আর অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকছে না। দেশটির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ভূরাজনৈতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করছে মস্কো।
পাঠক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। উদাহরণ দিচ্ছি। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্টের দহরম-মহরম চোখ এড়ানোর কথা নয়। টেলিভিশনের পর্দায় বারবারই দেখা গেছে এই দুই নেতাকে। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে প্রকাশ, শুধু খেলা দেখা নয়, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন তিনি। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা।
বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গিয়েছেন রাশিয়া। গ্রুপ পর্বে পর্তুগাল-মরক্কোর ম্যাচ উপভোগ করেছেন তিনি, দেখা করেছেন পুতিনের সঙ্গেও। রাশিয়ায় যাচ্ছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। তিন দিনের সফরে পুতিনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ও আলোচিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। রোস্তভ শহরে কোরিয়া-মেক্সিকো ম্যাচ দেখার কথা আছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, খেলার মাঠ এখন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উর্বর জমিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলার পাশাপাশি চলছে কূটনীতি। বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সৌজন্যে পাওয়া সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কূটনীতির জালে লাগাতার গোল দিয়ে যাচ্ছেন পুতিন।
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ক্রিমিয়া সংকট সত্ত্বেও ২০১৪ সালে সোচিতে আয়োজিত শীতকালীন অলিম্পিকে সফল হয়েছিলেন পুতিন। বিশ্বমঞ্চে রাশিয়াকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি এনে দিয়েছিল ওই অলিম্পিক আয়োজন। বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে আগের অর্জনকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তবে এবার প্রতিবন্ধকতাও বেশি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগ দিয়ে ডোপ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয় পুরো রুশ ক্রীড়াঙ্গন। বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়া নিয়েও বিতর্ক আছে। আলোচনায় আছে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাক গলানোর এবং যুক্তরাজ্যে সাবেক রুশ গুপ্তচরের ওপর বিষপ্রয়োগের অভিযোগ। এর ওপর আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে বাহাস তো আছেই। সব মিলিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জেরবার অবস্থায় ছিল পুতিনের রাশিয়া।
সিএনএন বলছে, ওপরের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের নেতারা বিশ্বকাপে এখনো দেখা দেননি। কিন্তু তাই বলে বয়েই গেল পুরো বিশ্বের। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। টিকিট বিক্রির দিক থেকে সর্বোচ্চ ১০টি দেশের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য। এসব দেশের সরকারপ্রধানেরা রাশিয়ায় না গেলেও সাধারণ জনগণ ঠিকই নেচে-গেয়ে মাতাচ্ছে স্টেডিয়াম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে রাশিয়া একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। তা হলো, পুরো বিশ্বকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে রাশিয়া এবং এটি কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে মোট খরচ হচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট হচ্ছে রাশিয়ার ১১টি শহরে। আর এসব শহরে নতুন নতুন স্টেডিয়াম ও অবকাঠামো নির্মাণে ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে রুশ সরকার। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের মোট ব্যয়ের তুলনায় এই অঙ্ক চার গুণ বেশি। অবশ্য বিভিন্ন ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি বলছে, এত ব্যয়ের পরও তা রুশ অর্থনীতিতে কমই প্রভাব রাখবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণের মূল বক্তব্যও একই।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করে কোনো দেশই অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের ধার ধারে না। এটি অনেক বড় একটি সম্মান। একই সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জাহির করার সুযোগও। রাশিয়ার বেলায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কূটনৈতিক বিভিন্ন চাল। বিশ্লেষকদের ধারণা, এ বিষয়েই বেশি মনোযোগ ভ্লাদিমির পুতিনের।
ঘরের আগুনও নিভু নিভু
বিশ্বকাপের ডামাডোলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু সংস্কার কার্যক্রম চালাচ্ছে রুশ সরকার। সিএনএন জানিয়েছে, সম্প্রতি পেনশন ব্যবস্থায় বদল এনে চাকরি থেকে অবসরের সময়সীমা নারীদের জন্য ৬৩ থেকে ৫৫ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। পুরুষদের জন্য এটি এখন ৬০ বছর, যা আগে ছিল ৬৫। এ নিয়ে দেশটিতে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ক্ষোভের আগুন দাবানল হচ্ছে না বিশ্বকাপের কারণেই।
ব্লুমবার্গ বলছে, রাশিয়ার মাত্র ২৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের হাতে পাসপোর্ট আছে। অর্থাৎ বেশির ভাগ রুশ নাগরিক বিদেশে যাওয়ার সুযোগই পান না। এমন অবস্থায় পুরো বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ হাজির হয়েছেন তাদের সামনে। একদিক দিয়ে এটি রুশদের জন্য বিশ্বদর্শনের সুযোগ। তার ওপর আবার আছে ফুটবল-জ্বর। এই হুলুস্থুলের মধ্যেই চুপিচুপি কাজ সারছে পুতিনের সরকার।
বিশ্বকাপের কারণে বেকায়দায় পড়েছে রাশিয়ার বিরোধী দলগুলোও। পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রতিবাদে র্যালি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনি ও তাঁর সংস্থা। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের আবেগের কথা ভেবে বিশ্বকাপের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে—এমন শহরে র্যালি করার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, মিটিমিটি হাসছেন পুতিন!
জয় শুধুই পুতিনের?
ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী এখন রাশিয়ায়। আয়োজক এই দেশে ফুটবল-ভক্তদের বর্ণবাদসহ বিভিন্ন অপরাধের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। এর সঙ্গে বিশ্বরাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন খোঁচা তো আছেই। সুতরাং বিচ্ছিন্ন সহিংসতার শঙ্কা হেলায় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
কারণ, রুশদের জাত্যভিমান প্রশ্নাতীত। সম্প্রতি এক রুশ আইনপ্রণেতা তো বলেই দিয়েছেন, জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে বিদেশি ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে রুশ নারীদের যৌন সংসর্গ করা উচিত হবে না। আবার খেলার প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধারণাও মিশে যায়।
সংবাদমাধ্যম কোয়ার্টজে লেখা কলামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির সরকার বিভাগের অধ্যাপক পিটার রুটল্যান্ড বলেছেন, বিশ্বকাপে মাঠ বা মাঠের বাইরে ঝামেলা হোক বা না হোক, জয়ী পক্ষের নামে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সেই নাম হলো ভ্লাদিমির পুতিন। তিনিই এই আয়োজনের চূড়ান্ত বিজয়ী।
কথায় আছে, সব ভালো যার, শেষ ভালো তার। বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের শুরুতে টানা জয় পেয়ে আকাশে উড়ছে রাশিয়ার ফুটবল দল। উড়ছেন পুতিনও। এবার শেষটা ভালো করার পালা!